ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যর্থ হলে কংগ্রেসের উগ্রপন্থী অংশের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তাকেই স্বদেশী আন্দোলন বলা হয় । এ আন্দোলনের মূল কর্মসূচি ছিল দুইটি— বয়কট ও স্বদেশী ।
‘বয়কট' আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিলেতি পণ্য বর্জন । ক্রমে ক্রমে বয়কট' শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হতে থাকে । বয়কট শুধু বিলেতি পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বিলেতি শিক্ষা বর্জনও কর্মসূচিতে যুক্ত হয়। ফলে স্বদেশী আন্দোলন শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে রূপ নেয় । বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন করার অপরাধে সরকারি স্কুল-কলেজ থেকে বহু শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়া হয়। যে কারণে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দেয় । জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ফলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং কয়েকটি কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্রও গড়ে ওঠে ।
স্বদেশী আন্দোলন ক্রমশ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে । বিলেতি শিক্ষা বর্জনের মতো পণ্য বর্জনের জন্যও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় । স্থানে স্থানে সমিতির মাধ্যমে বিলেতি পণ্য বর্জন এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারে শপথ নেওয়া হয়। কংগ্রেস নেতারা গ্রামে-গঞ্জে-শহরে প্রকাশ্য সভায় বিলেতি পণ্য পুড়িয়ে ফেলা এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে থাকেন । ফলে বিলেতি পণ্যের চাহিদা কমে যেতে থাকে । একই সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এ সময় দেশি তাঁতবস্ত্র, সাবান, লবণ, চিনি ও চামড়ার দ্রব্য তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে।
স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত হতে থাকে । আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ানোর জন্য বাংলার জেলায় জেলায় বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেমন- ঢাকায় অনুশীলন, কোলকাতায় যুগান্তর সমিতি, বরিশালে স্বদেশীবান্ধব, ফরিদপুর ব্রতী, ময়মনসিংহে সাধনা ইত্যাদি সংগঠনের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো । জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কবি-সাহিত্যিকরা দেশাত্মবোধক বিভিন্ন রচনা পত্রিকায় লিখতে থাকেন । এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রজনীকান্ত সেন প্রমুখ । বরিশালের চারণ কবি মুকুন্দ দাস গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে আন্দোলনের পক্ষে মানুষের মনে দেশপ্রেম জাগাতেও সক্ষম হন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকাও বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । এক্ষেত্রে বেঙ্গলি, সঞ্জীবনী, যুগান্তর, অমৃতবাজার, সন্ধ্যা হিতবাদীসহ বাংলা-ইংরেজি পত্রিকা স্বদেশ প্রেম ও বাঙালি জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধ লেখা ছাপতে থাকে । বাংলার নারীসমাজ স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশ নিতে শুরু করে ।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পূর্ব বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থবিরোধী হলেও কিছু মুসলমান নেতা প্ৰাথমিক পর্যায়ে একে সমর্থন করেছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে যোগ দেননি। তাছাড়া স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে হিন্দুধর্মের আদর্শ-আচার অনুষ্ঠানের প্রভাব থাকার কারণে মুসলমান সমাজ এ থেকে দূরে থাকে । স্বদেশী আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক ছিল বাংলার জমিদার শ্রেণি । কারণ বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ছিল মুসলমান । তারা ভূমিব্যবস্থার কারণে চরমভাবে শোষিত হচ্ছিল। অত্যাচারিত হচ্ছিল জমিদার ও তাদের নায়েব-গোমস্তাদের দ্বারা । যে কারণে জমিদারদের প্রতি কৃষকরা ক্ষুব্ধ ছিল । আবার এই জমিদারদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু । জমিদারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ অনেক দরিদ্র হিন্দু কৃষকও বঙ্গভঙ্গের সমর্থক ছিল ।
মুসলমান সমাজ দূরে থাকার কারণে স্বদেশী আন্দোলন জাতীয় রূপ লাভে ব্যর্থ হয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বিলেতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনও সফল হয়নি। কারণ কোলকাতার মাড়োয়ারি অবাঙালি ব্যবসায়ী এবং বাংলার গ্রামগঞ্জের ব্যবসায়ীরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি । সর্বোপরি গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে অগ্রসর হলে এ আন্দোলন থেকে জনগণ দূরে সরে যায় । ফলে গণবিচ্ছিন্ন আন্দোলন সফলতার দ্বারে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় ।
মুসলিম সমাজ এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে আন্দোলন শক্তিশালী হতে পারেনি । সাধারণ মানুষ, এমনকি নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়, দরিদ্র সমাজও এই আন্দোলনের মর্ম বোঝার চেষ্টা করেনি। ফলে আন্দোলন সর্বজনীন এবং জাতীয় রূপ লাভ করতে ব্যর্থ হয় । এর উপর চলে ইংরেজ সরকারের চরম দমননীতি, পুলিশি অত্যাচার । সবকিছু মিলে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন ব্যর্থ হয় । স্বদেশী আন্দোলনে তাৎক্ষণিক সফলতা না এলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণসচেতনতার জন্ম হয় । এ আন্দোলন উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করে । আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রসমাজ যুক্ত হওয়ার কারণে গুরুত্ব যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনই জনগণ রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠে।
ভারতের পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে তাদের উপস্থিতির শুরু এখান থেকেই । এই আন্দোলনের আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি । এর ফলে দেশী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপনের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় । এদেশীয় ধনী ব্যক্তিরা কলকারখানা স্থাপন করতে থাকেন। যেমন : স্বদেশী তাঁত বস্ত্র, সাবান, লবণ, চিনি, কাগজ, চামড়াজাত দ্রব্য ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন স্থানে কলকারখানা স্থাপিত হয়। ঐ সময় আধুনিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেমন বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠিত হয়, বিখ্যাত টাটা কোম্পানি ১৯১০ সালে কারখানা স্থাপন করে । তাছাড়া আরো ছোটখাটো দেশি শিল্পকারখানা এই সময় প্রতিষ্ঠিত হয় । পাশাপাশি বিজ্ঞান, শিক্ষা, ভাষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আগ্রহ উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত, মুকুন্দ দাসের বাঙালি জাতি চেতনায় সমৃদ্ধ এবং দেশাত্মবোধক গানগুলো ঐ সময় রচিত । ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঐ সময়ে রচনা করেন যা আমাদের জাতীয় সংগীত । স্বদেশী আন্দোলনের হতাশার দিক হচ্ছে, এই আন্দোলনের কারণে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল ধরে । নানা ঘটনার মাধ্যমে এই তিক্ততা ক্রমশ বাড়তে থাকে । বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ভাঙনের সূত্রপাত, স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে তা আরো তিক্ত হয় । ফলে সম্পর্কের এই ভাঙন এদেশের রাজনীতি, সমাজ ও জাতীয় কর্মকাণ্ডের সকল ক্ষেত্রে সর্বাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে থাকে, যা শেষ হয় ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে ।
Read more